মাত্র ১৬ বছর বয়সে নিজের শোবার ঘর থেকেই শুরু হয়েছিল উদ্ভাবনী যাত্রা। পুরোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ জোড়া লাগিয়ে তৈরি করেছিলেন প্রথম ‘রোবট’। জয় বড়ুয়া লাভলুর সেই ছোট্ট স্বপ্নই পরিণত হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘রোবোলাইফ টেকনোলজিস’ প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য আধুনিক, সাশ্রয়ী মূল্যের রোবোটিক প্রযুক্তি তৈরি করে জীবনমান উন্নত করতে ভূমিকা রাখছে।
চট্টগ্রামের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ইলেকট্রনিকসে ডিপ্লোমা শেষ করে ইউনাইটেড কলেজ অব এভিয়েশন থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন জয় বড়ুয়া। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ১১ নম্বর ফতেপুর ইউনিয়নের জোবড়া গ্রামের সন্তান জয় বড়ুয়া লাভলু। বাবা রবি বড়ুয়া পেশায় ছিলেন আসবাবমিস্ত্রি, আর মা রীণা বড়ুয়া জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্যের বাসায় কাজ করতেন। দারিদ্র্য ও সংগ্রামের এমন পরিবেশেই বেড়ে ওঠেন লাভলু।
স্কুলে পড়ার সময় বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকেরা তাঁকে ‘নিউটন’ বলে ডাকতেন। আত্মীয়স্বজন ও স্কুলের সহপাঠী বন্ধুদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘খুদে বিজ্ঞানী’ হিসেবে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকেই রোবোটিকস উদ্ভাবনী চিন্তা তাঁর মাথায় ভর করে। পড়ালেখার পাশাপাশি একের পর এক বানাতে থাকেন বিভিন্ন রোবোটিক যন্ত্র। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাত কাটা পড়া শিক্ষার্থীর গামছা দিয়ে শরীরের অঙ্গহীন অংশ লুকিয়ে চলাফেরা করার করুণ দৃশ্য আবেগতাড়িত করে ছোট্ট লাভলুকে। তখনই তাঁদের জন্য কিছু একটা করার তীব্র ইচ্ছা জাগে তাঁর মনে। কয়েক বছরের কঠিন গবেষণা ও পরিশ্রমে ২০১৯ সালেই লাভলু তৈরি করতে সক্ষম হন ওয়্যারলেস হাতের প্রটোটাইপ।
মস্তিষ্ক থেকে আসা স্নায়বিক সংকেত ব্যবহার করে এই হাত কাজ করে হুবহু মানব অঙ্গের মতোই। এ পর্যন্ত হাত হারানো শতাধিক ব্যক্তি উপকৃত হয়েছেন লাভলুর ওয়্যারলেস হাত ব্যবহারের মাধ্যমে। এরই মধ্যে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও তুরস্কে রোবোটিক হাত ডেমো প্রোডাক্ট হিসেবে রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
জয় বড়ুয়া লাভলুর এই উদ্ভাবন দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। দেশে সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতির পাশাপাশি নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ, ইউএনডিপি স্প্রিংবোর্ড প্রোগ্রাম এবং জাপানের জাপানের ম্যাডটেক ট্রেড ফেয়ারে তাঁর প্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে ‘স্টার্টআপ ওয়ার্ল্ড কাপ’–এ চ্যাম্পিয়ন হয় লাভলুর রোবোলাইফ।
চট্টগ্রামের এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এই তরুণ স্বপ্নবাজ উদ্যোক্তার গল্প শুধু প্রযুক্তি উদ্ভাবনের নয়, বরং সংগ্রাম ও অধ্যবসায়ের। প্রযুক্তি কেবল যন্ত্র নয়, এটি মানুষের জীবন পরিবর্তনের হাতিয়ার—তা প্রমাণ করছেন জয় বড়ুয়া লাভলু।