প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা রাঙামাটির মগাছড়ি গ্রামের সাধারণ এক পরিবারে জন্ম ঋতুপর্ণা চাকমার। পাহাড়ি জনপদের অন্য শিশুদের মতো তিনিও বড় হচ্ছিলেন প্রকৃতিকে সঙ্গী করে।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই ফুটবলচর্চা শুরু হয় ঋতুপর্ণার। তখনই একদিন ফুটবল খেলতে গিয়ে ব্যথা পান পায়ের আঙুলে। সেই কষ্ট থেকেই হয়তো ভেবেছিলেন ফুটবল আর খেলবেনই না। কিন্তু মগাছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা বুঝতে পেরেছিলেন, এই মেয়ের পায়ে লুকিয়ে আছে অন্য রকম জাদু। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঋতুপর্ণার প্রতিভাও বিকশিত হয়েছে দারুণভাবে। আজ তিনি শুধু নারী ফুটবলেই নয়, অনেকের চোখেই দেশের সেরা অ্যাথলেট হয়ে উঠেছেন।
যার ভিত্তিভূমি ছিল বিকেএসপি। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় তাঁর নতুন যাত্রা। বিভিন্ন জাতীয় বয়সভিত্তিক দল পেরিয়ে এখন তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের প্রাণভোমরা। ২০১১ সালে বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে স্কুল দলের হয়ে মাঠে নামেন ছোট্ট ঋতুপর্ণা। দলের ফাইনালে ওঠার পেছনে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে আলো ছড়ানোর শুরুটা তখন থেকেই। সেই আলো এখনো ধারাবাহিকভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে ২২ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড জাতীয় দলের হয়ে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে যাচ্ছেন।
২০২৪ সালের অক্টোবরে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়সূচক গোলটা আসে ঋতুর্পণার বাঁ পায়ের জাদুতেই। পরপর দুবার সাফের চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ আর টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন ঋতুপর্ণা।
চলতি বছরের জুলাই মাসে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত এএফসি নারী এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ঋতুপর্ণা। বাংলাদেশের চেয়ে ৫৫ ধাপ এগিয়ে থাকা মিয়ানমারের বিপক্ষে তাদেরই মাঠে ২–১ গোলে ঐতিহাসিক জয় পান ঋতুপর্ণারা। আর বাংলাদেশের দুটি গোলই আসে ঋতুপর্ণার বাঁ পায়ের ছোঁয়ায়। মিয়ানমারের বিপক্ষে এই জয় প্রথমবারের মতো এশিয়ার মঞ্চে নিয়ে যায় বাংলাদেশকে।
ফুটবলের বাইরে ঋতুপর্ণা চাকমার জীবনও এক সংগ্রামের গল্প। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে পড়াশোনার পাশাপাশি অসুস্থ মায়েরও দেখভালের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। পাহাড়ি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, খরচের দায়ভার বহন—সবকিছু সামলাচ্ছেন অসমসাহস ও অদম্য মনোবলে।
ঋতুপর্ণা শুধু জাতীয় দলের একজন ফুটবলারই নন, অসংখ্য তরুণ–তরুণীর অনুপ্রেরণা। পাহাড়ি জনপদের মেয়ে হয়েও তিনি দেখিয়েছেন স্বপ্ন ও দৃঢ়তা থাকলে লক্ষ্য অর্জনে সীমাবদ্ধতা কোনো বাধা নয়।